করোনা মহামারির সময়কালে আমি একটি ব্যান্ডের সাথে পরিচিত হই, যার নাম ছিল ‘সিলসিলা’। এই ব্যান্ডের সদস্যদের মধ্যে সে সময় দুইজনের সাথে আমার পরিচয় হয়—লুৎফর রহমান এবং খালিদ হাসান আবিদ। টিএসসি কেন্দ্রিক আরও কয়েকটি ব্যান্ড থাকলেও সিলসিলা ছিল একেবারে আলাদা। কারণ, এই ব্যান্ডটিই ছিল একমাত্র যারা কাওয়ালী পরিবেশন করত। মূলত ২০২০ সালের বই মেলায় কাওয়ালী পরিবেশন করেই তারা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
সেই সময় থেকেই আমার মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার বীজ রোপিত হয়। রাজনীতির প্রতি আগ্রহ আগে থেকেই ছিল, তবে এই সময়টি আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ তখন থেকেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে আমার ওঠাবসা শুরু হয়।
মনে পড়ে, আমরা একসময় ‘কাবাব কাস্ট’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেছিলাম। যদিও বিভিন্ন কারণে প্রকল্পটি সফল হয়নি, তবুও এর মাধ্যমে বেশ কিছু মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়। সেই পরিচয় থেকেই তুহিন খান, জাহিদ আহসানসহ অনেকের সাথে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। বিশেষভাবে উগান্ডার কৃষিবিদ ও ফ্রেশি ফার্মের উদ্যোক্তা মুজাহিদুল ইসলাম জাহিদের সাথেও প্রথম পরিচয় ঘটে এই প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে। আমাদের পুরো ওয়েবসাইটটি নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তিনি নিজেই নিয়েছিলেন।
তখন মোদির বাংলাদেশ সফরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। গুজরাট ম্যাসাকার থেকে শুরু করে কাশ্মীরের হত্যাকাণ্ডের জন্য পরিচিত এই ব্যক্তি যখন বাংলাদেশে আসার ঘোষণা দেয়, তখন দেশজুড়ে প্রতিবাদের ডাক ওঠে। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি, এবং আমার বন্ধু হাফিজকে সাথে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেই যে আমরাও এই প্রতিবাদে যোগ দেব। আমরা তুহিন ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করি, এবং ভাই আমাদেরকে টিএসসি যেতে বলেন, যেখানে আমরা একসাথে মিছিলে যোগ দেব।
সকালে টিএসসি থেকে মিছিল শুরু হয়, যা ধীরে ধীরে দোয়েল চত্বরে পৌঁছে। সেখানে প্রথম পুলিশ ব্যারিকেডের মুখোমুখি হই আমরা। বামদলের এক নেতা মিছিলের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকেন, তবে পিছনের সারি থেকে কিছু সাহসী যুবক এগিয়ে এসে ব্যারিকেড ভেঙে মিছিলকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমি দেখি, নেতাটি এই ছেলেদের চড় থাপ্পড় মারছেন, যা দেখে হতবাক হয়ে যাই। পরবর্তী ব্যারিকেডে পৌঁছালে মিছিলটি বসে পড়ে। আমি আর হাফিজ হতবাক হই; তখনও আমরা বুঝতাম না যে এই ধরনের পরিস্থিতিতে দলীয় রাজনীতির ডিলিংস কেমন হয়।
ঘরে ফিরে হঠাৎ জানতে পারি, ‘মোদির আগমনে শাহবাগে গরু জবাই’ নামে একটি কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। আমার কাছে এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছিল, কারণ গোমাংস রাজনীতির মাধ্যমে হাজারো মানুষ হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এই নেতাকে স্বাগত জানানোর এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারে?
সেখানে গিয়ে দেখি এক অভাবনীয় দৃশ্য; গরু জবাই হয়ে গেছে, কিন্তু জেয়াফতের খিচুড়ির ডেকচি ছাত্রলীগ চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছে। আমি আন্দোলনে হামলা বা বাধার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু খাবার চুরি করার এমন ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। শেষে ডেকচি ফেরত এনে খিচুড়ি বিতরণ সম্পন্ন করা হয়। সেইদিনই রাতুল মোহাম্মদের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। ভারতের আগ্রাসনবিরোধী এ শক্তিশালী মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিত্বের মতো আর কাউকে দেখিনি। তার আয়োজিত জেয়াফতে আরো কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হলেও, সেদিনের মতো স্বাদ আর কখনো পাইনি।
খিচুড়ি খেতে গিয়ে সেদিন দুইজন মানুষকে দেখি: জারিফ এবং আরাফাত শৈশব। কখনো ভাবিনি, এরা একসময় এত আপন হয়ে উঠবে। এর আগে অবশ্য একবার আরাফাত শৈশবকে দেখেছিলাম। মুশতাকের গায়েবানা জানাজার পর ড. জাফরুল্লাহর গাড়িবহর আটকে সে সেলফি তুলছিল। সেইটা অবশ্য আরেক গল্প।
সেদিন কেন যেন সেই প্রোগ্রামের ছবি তুলেছিলাম। তখন তেমন ছবি তুলতাম না। বাসায় এসে ভাবলাম, পোস্ট করে দিই। পোস্ট করেই বন্ধুর সাথে এলাকায় ঘুরতে বের হলাম। ফিরে এসে দেখি পোস্টটা ভাইরাল। একদিনের মধ্যেই ভারতের আরএসএস থেকে আমাদের ছাত্রলীগ— সবাই আমাকে হুমকি দিতে শুরু করল।
এরমধ্যে এক সন্ধ্যায় টিএসসি-তে জাহিদ আহসানের সাথে দেখা করতে যাই। সেই সময় জাহিদ ভাই হয়ে গেছে। মিটিং শেষে চা খেতে যাওয়ার সময় ফেসবুকের এক বন্ধু আকরাম হোসেন সিএফ এসে আমার হাতে ধরে জিজ্ঞাসা করে, “কেমন আছ?” এই ‘সিএফ’ মানে এখনো জানি না। তবে সেদিন একজন ভাই বানিয়েছিলাম।
সেইদিন আরও দুইজনের সাথে পরিচয় হলো: সালেহ উদ্দিন সিফাত এবং লুৎফর রহমান। সেদিন থেকেই লুৎফর ভাই হয়ে গেলেন।
পরিচয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই সব ওলট-পালট হয়ে গেল। আকরাম ভাইকে বিমানবন্দর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হলো। জাহিদ ভাই পুলিশ পিটিয়ে খবরের শিরোনাম হয়ে গেলেন। এদিকে আমার পোস্ট গ্লোবাল ভাইরাল, হুমকিধামকি চলছে। আনানকে বললাম, ভয় লাগছে, বাইরে গেলে যেন সাথে থাকে। আমার পরিবার অন্তত জানুক কী হয়।
দুই হাজার বাইশে আমাদের একটা বন্ধুমহল গড়ে উঠল। সবাই মিলে মোদিবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে গেলাম। আকরাম ভাই জানালেন, টিএসসিতে কাওয়ালী আয়োজন হবে। ব্যানার টাঙানো হলো। শহরজুড়ে নতুন আয়োজনে সবাই আগ্রহী।
কিন্তু কিছু লোক ফেসবুকে আলোচনা শুরু করল—কাওয়ালী হালাল নাকি হারাম। ঢাকায় কনসার্ট হয়, কেউ সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন করে না। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতা, এখন বিসিএস ডাক্তার, ধর্মের নামে এটা উসকে দিলেন।
এরপর বর্তমান ছাত্রলীগ সভাপতির নেতৃত্বে একদল এসে প্রোগ্রামের আগের দিন ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। বুঝতে পারছিলাম, একটা গণ্ডগোল হবে। আমরা ঠিক করলাম, তবুও যাব।
প্রোগ্রামের দিন টিএসসি পৌঁছেই অস্বস্তি লাগল। ডাসের দিকে রবীন্দ্র সংগীতের অনুষ্ঠান চলছে কিন্তু লোকজন নেই। আর পায়রাচত্তরে ঠাসা ভিড়, কিন্তু কোনো আলো নেই। ছাত্রলীগ সাউন্ডবক্স আটকে দিয়েছে।
এনাম আমাকে দেখে একটা ভলিন্টিয়ার কার্ড দিয়ে স্টেজের দিকে পাঠাল। দর্শকরা বসে আছে, কিন্তু সবার মুখ শুকনো। ছাত্রলীগ হামলা করবে বলেই হয়তো। তবুও রিজওয়ান ভাই উঠে খালি গলায় গান শুরু করলেন, লুৎফর ভাইও যোগ দিলেন। পরিবেশে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। কিন্তু কিছু যেন ঠিক ঠেকছিল না।
স্টেজে উঠে সিফাত ভাইকে বলছিলাম যে পরিস্থিতি ভালো লাগছে না। বলতেই, মেট্রোরেল সাইডের গেটের দেয়াল টপকে ছাত্রলীগ ঢুকল, কাওয়ালদের আক্রমণ করল, স্টেজ ভাঙল। মুহূর্তেই সব তছনছ হয়ে গেল!
কীভাবে মাইর খাইনি জানি না। লাফ দিয়ে স্টেজ থেকে নামলাম, বাঁশ টপকে পালালাম। মাথার আজমির থেকে আনা টুপিটা ব্যাগে ভরে ফেললাম। আগে কখনো ভাবিনি যে ভয়ে টুপি খুলতে হবে।
একটা প্রশ্ন ছিল: হামলার সময় এত বড়ভাই টিএসসি ছেড়ে উদ্যানের গেটে কী করছিলেন? ভবিষ্যতের মাস্টারমাইন্ডরা আয়োজনে যুক্ত থাকলেও হামলার সময় কেউই উপস্থিত ছিলেন না। কোনো একদিন হয়তো বুঝব। সেদিন পালিয়ে কাটাবন মসজিদে গেলাম, সজল ভাই ছিলেন। সবাই ভীত হলেও বললাম, “ভাই, কাওয়ালী গাইতে দিবে না কেন? আজকে না হোক, কালকে গাইবই।”
এরপর সজল ভাইয়ের সাথে কথা বলে কনকর্ডের নিচে আড্ডা দিলাম। পরের দিন লুৎফর ভাই টিএসসি এসে কাওয়ালী গাইলেন, সবাই মুগ্ধ। এরপর প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাবিতে কাওয়ালী আয়োজন শুরু হলো। ঈদে মিলাদুন্নবীতে সজল ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার কাওয়ালী হবে। আমরা সাথে থাকলাম। পুরাতন পল্টনে একটা রেস্টুরেন্ট ভাড়া করে বিশ পঁচিশজনের ঘরোয়া আয়োজন করলাম। লুৎফর ভাইয়ের সিলসিলা, ফাহিম ফয়সাল সবাই উপস্থিত। সিরাত নিয়ে আলোচনা এবং কাওয়ালী গানে এক আধ্যাত্মিক সন্ধ্যা কাটালাম।
এরপর দুই হাজার তেইশের ফেব্রুয়ারিতে বৃহস্পতিবারের কাওয়ালী আসরে লুৎফর ভাই যান। গিয়ে দেখেন, দলের কেউ নেই; বরং ছাত্রলীগ নেতা সৈকতের গ্রুপ অপেক্ষায়। তাঁকে মারধর করে, হাতের আঙুল পর্যন্ত ভেঙে দেয়। কেন? কারণ তিনি গান গাইতে চেয়েছিলেন।
এবারের হামলায় আমরা কিছুটা ফ্রাস্ট্রেটেড হলাম। একজন মানুষকে গান গাওয়ার অপরাধে পেটানো হয় কীভাবে? আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার আয়োজন হবে আরও বড়। সজল ভাইকে ধরলাম, ভাই, মিলাদুন্নবীতে কাওয়ালী করবেন। সাথে যোগ দিলেন স্পিক বাংলাদেশের সংগঠক তওহিদ ভাই, জাহিদ ভাই, তনয় ভাই ও তাঁর গ্রুপ।
খিচুড়ি খেতে গিয়ে সেদিন দুইজন মানুষকে দেখি: জারিফ এবং আরাফাত শৈশব। কখনো ভাবিনি, এরা একসময় এত আপন হয়ে উঠবে। এর আগে অবশ্য একবার আরাফাত শৈশবকে দেখেছিলাম। মুশতাকের গায়েবানা জানাজার পর ড. জাফরুল্লাহর গাড়িবহর আটকে সে সেলফি তুলছিল। সেইটা অবশ্য আরেক গল্প।
সেদিন কেন যেন সেই প্রোগ্রামের ছবি তুলেছিলাম। তখন তেমন ছবি তুলতাম না। বাসায় এসে ভাবলাম, পোস্ট করে দিই। পোস্ট করেই বন্ধুর সাথে এলাকায় ঘুরতে বের হলাম। ফিরে এসে দেখি পোস্টটা ভাইরাল। একদিনের মধ্যেই ভারতের আরএসএস থেকে আমাদের ছাত্রলীগ— সবাই আমাকে হুমকি দিতে শুরু করল।
এরমধ্যে এক সন্ধ্যায় টিএসসি-তে জাহিদ আহসানের সাথে দেখা করতে যাই। সেই সময় জাহিদ ভাই হয়ে গেছে। মিটিং শেষে চা খেতে যাওয়ার সময় ফেসবুকের এক বন্ধু আকরাম হোসেন সিএফ এসে আমার হাতে ধরে জিজ্ঞাসা করে, “কেমন আছ?” এই ‘সিএফ’ মানে এখনো জানি না। তবে সেদিন একজন ভাই বানিয়েছিলাম।
সেইদিন আরও দুইজনের সাথে পরিচয় হলো: সালেহ উদ্দিন সিফাত এবং লুৎফর রহমান। সেদিন থেকেই লুৎফর ভাই হয়ে গেলেন। পরিচয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই সব ওলট-পালট হয়ে গেল। আকরাম ভাইকে বিমানবন্দর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হলো। জাহিদ ভাই পুলিশ পিটিয়ে খবরের শিরোনাম হয়ে গেলেন। এদিকে আমার পোস্ট গ্লোবাল ভাইরাল, হুমকিধামকি চলছে। আনানকে বললাম, ভয় লাগছে, বাইরে গেলে যেন সাথে থাকে। আমার পরিবার অন্তত জানুক কী হয়।
২০২২ খ্রিষ্টাব্দে আমাদের একটা বন্ধুমহল গড়ে উঠল। সবাই মিলে মোদিবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে গেলাম। আকরাম ভাই জানালেন, টিএসসিতে কাওয়ালী আয়োজন হবে। ব্যানার টাঙানো হলো। শহরজুড়ে নতুন আয়োজনে সবাই আগ্রহী।
কিন্তু কিছু লোক ফেসবুকে আলোচনা শুরু করল—কাওয়ালী হালাল নাকি হারাম। ঢাকায় কনসার্ট হয়, কেউ সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন করে না। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতা, এখন বিসিএস ডাক্তার, ধর্মের নামে এটা উসকে দিলেন।
এরপর বর্তমান ছাত্রলীগ সভাপতির নেতৃত্বে একদল এসে প্রোগ্রামের আগের দিন ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। বুঝতে পারছিলাম, একটা গণ্ডগোল হবে। আমরা ঠিক করলাম, তবুও যাব। প্রোগ্রামের দিন টিএসসি পৌঁছেই অস্বস্তি লাগল। ডাসের দিকে রবীন্দ্র সংগীতের অনুষ্ঠান চলছে কিন্তু লোকজন নেই। আর পায়রাচত্তরে ঠাসা ভিড়, কিন্তু কোনো আলো নেই। ছাত্রলীগ সাউন্ডবক্স আটকে দিয়েছে।
এনাম আমাকে দেখে একটা ভলিন্টিয়ার কার্ড দিয়ে স্টেজের দিকে পাঠাল। দর্শকরা বসে আছে, কিন্তু সবার মুখ শুকনো। ছাত্রলীগ হামলা করবে বলেই হয়তো। তবুও রিজওয়ান ভাই উঠে খালি গলায় গান শুরু করলেন, লুৎফর ভাইও যোগ দিলেন। পরিবেশে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। কিন্তু কিছু যেন ঠিক ঠেকছিল না। স্টেজে উঠে সিফাত ভাইকে বলছিলাম যে পরিস্থিতি ভালো লাগছে না। বলতেই, মেট্রোরেল সাইডের গেটের দেয়াল টপকে ছাত্রলীগ ঢুকল, কাওয়ালদের আক্রমণ করল, স্টেজ ভাঙল। মুহূর্তেই সব তছনছ হয়ে গেল!
কীভাবে মাইর খাইনি জানি না। লাফ দিয়ে স্টেজ থেকে নামলাম, বাঁশ টপকে পালালাম। মাথার আজমির থেকে আনা টুপিটা ব্যাগে ভরে ফেললাম। আগে কখনো ভাবিনি যে ভয়ে টুপি খুলতে হবে।
একটা প্রশ্ন ছিল: হামলার সময় এত বড়ভাই টিএসসি ছেড়ে উদ্যানের গেটে কী করছিলেন? ভবিষ্যতের মাস্টারমাইন্ডরা আয়োজনে যুক্ত থাকলেও হামলার সময় কেউই উপস্থিত ছিলেন না। কোনো একদিন হয়তো বুঝব। সেদিন পালিয়ে কাটাবন মসজিদে গেলাম, সজল ভাই ছিলেন। সবাই ভীত হলেও বললাম, “ভাই, কাওয়ালী গাইতে দিবে না কেন? আজকে না হোক, কালকে গাইবই।”
এরপর সজল ভাইয়ের সাথে কথা বলে কনকর্ডের নিচে আড্ডা দিলাম। পরের দিন লুৎফর ভাই টিএসসি এসে কাওয়ালী গাইলেন, সবাই মুগ্ধ। এরপর প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাবিতে কাওয়ালী আয়োজন শুরু হলো। ঈদে মিলাদুন্নবীতে সজল ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার কাওয়ালী হবে। আমরা সাথে থাকলাম। পুরাতন পল্টনে একটা রেস্টুরেন্ট ভাড়া করে বিশ পঁচিশজনের ঘরোয়া আয়োজন করলাম। লুৎফর ভাইয়ের সিলসিলা, ফাহিম ফয়সাল সবাই উপস্থিত। সিরাত নিয়ে আলোচনা এবং কাওয়ালী গানে এক আধ্যাত্মিক সন্ধ্যা কাটালাম।
এরপর দুই হাজার তেইশের ফেব্রুয়ারিতে বৃহস্পতিবারের কাওয়ালী আসরে লুৎফর ভাই যান। গিয়ে দেখেন, দলের কেউ নেই; বরং ছাত্রলীগ নেতা সৈকতের গ্রুপ অপেক্ষায়। তাঁকে মারধর করে, হাতের আঙুল পর্যন্ত ভেঙে দেয়। কেন? কারণ তিনি গান গাইতে চেয়েছিলেন।
এবারের হামলায় আমরা কিছুটা ফ্রাস্ট্রেটেড হলাম। একজন মানুষকে গান গাওয়ার অপরাধে পেটানো হয় কীভাবে? আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার আয়োজন হবে আরও বড়। সজল ভাইকে ধরলাম, ভাই, মিলাদুন্নবীতে কাওয়ালী করবেন। সাথে যোগ দিলেন স্পিক বাংলাদেশের সংগঠক তওহিদ ভাই, জাহিদ ভাই, তনয় ভাই ও তাঁর গ্রুপ।
তখন আমরা আসলে সম্পূর্ণ প্রস্তুত নই। তবু কাওয়ালী আয়োজনের জন্য সবার মধ্যে একধরনের উত্তেজনা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি ছিলো। মাশনুন আমাদের সবার জন্য তাড়া লাগাচ্ছিলো যেনো সব ঠিকঠাক সময়মতো শেষ হয়। আমরা এসে একে একে যন্ত্রপাতি ঠিক করলাম, সাউন্ড সিস্টেম টেস্ট করলাম, আর প্রতিটি আয়োজনের খুঁটিনাটি দেখে নিলাম।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে লোকজন আসতে শুরু করলো। ভেতরে ভেতরে আমাদের সবারই একটু ভয় ছিলো—কোথাও যেনো আগেরবারের মতো কোনো সমস্যা না হয়। তবুও সবাই নিজেদের দায়িত্বে মনোযোগী ছিলো। মাশনুন, আদিব, আয়াজ, আর ছোট ভাই আসিফ সবাই মিলে একে একে আসা দর্শকদের বসতে সাহায্য করছিলো।
একটা নিরবচ্ছিন্ন শান্তি আর রহস্যময় অনুভূতি চারদিকে বিরাজ করছিলো। যখন লুৎফর ভাইয়ের সিলসিলা আর ফাহিম ফয়সালের দল মঞ্চে উঠলো, সবার মধ্যে যেন এক নতুন উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়লো। প্রার্থনা আর সুরের ছোঁয়ায় শুরু হলো কাওয়ালী। দর্শকদের মধ্যেও যেনো নতুন এক জীবনের স্পন্দন দেখা দিলো। সব ভয়, সংশয় দূর করে সবাই একসঙ্গে সেই সুরে ভেসে গেলো।
এবারের আয়োজনে আর কেউ বাঁধা দিতে এলোনা। সুরের সেই মূর্ছনায় আমরা হারিয়ে গেলাম। মনে হলো, এত সংগ্রাম, এত চেষ্টার পর অবশেষে একটা পূর্ণাঙ্গ মুহূর্তের সাক্ষী হতে পেরেছি আমরা। যেনো এই সংগীতের মাধ্যমে আমরা আমাদের সাহস, ভালোবাসা, এবং বিশ্বাস প্রকাশ করতে পারলাম। কোনো বাধাই আমাদের এই সুর, এই ভালোবাসা থেকে দূরে রাখতে পারবে না।
সেদিনের পর থেকে কাওয়ালীর এই আসর আমাদের কাছে আরেকটি বিজয়ের প্রতীক হয়ে রইলো। এই আয়োজন আমাদের মধ্যে একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস আরও দৃঢ় করলো, আর আমাদের স্বপ্ন দেখালো যে সুর আর সাহসের এই জার্নি কোনো বাধা ছাড়াই সামনে এগিয়ে যাবে।
আমার মনটা যেন আটকে আছে সিলসিলা আর রিজওয়ান শেখের মধ্যে। কাওয়ালী বললেই আমি এদেরকেই বুঝি। যাকে আপনারা সমন্বয়ক লুৎফর নামে চিনেন, সেই আমার কাছে কাওয়ালের লুৎফর। তারাই আমার কাছে কাওয়ালী। শেখ ফাহিম ফয়সাল আমার কাওয়াল, স্পিক বাংলাদেশের সংগঠকরা কিংবা তনয় ভাইদের সেই গ্রুপটাই আমার কাছে কাওয়ালী।
স্বাধীন বাংলায় তাদের এই অবদান আমরা হয়তো মনেও করছি না। রিজওয়ান ভাইয়ের লা ইলাহার মধ্যে যে অসীম কুন ফায়া কুনের সুর মিশে ছিল, তা আজ হারিয়ে গেছে। হাসিখুশি মুখগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকা আহত লুৎফর রহমানকে আমরা দেখছি না। তবুও যতবারই জানতে চাইব যে কাওয়ালী কীভাবে ইনকিলাবের ভাষা হয়ে উঠল, আমরা শুধুই তাদেরকে স্মরণ করব। আমরা সেটা করতে বাধ্য!