গণঅভ্যুত্থান ও মওলানা ভাসানী

গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/জলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়’- সামসুর রাহমানের কবিতার মতোই সেদিন আসাদের রক্ত ভেজা শার্ট হাওয়ায় উড়ছিলো সংগ্রামী জনতার দৃপ্ত কাহন হয়ে। দিনটি ছিল ২০ জানুয়াারি ১৯৬৯ সাল। ঢাকার রাজপথ শ্লোাগান-মিছিলে উত্তাল। ক্রমশইঃ আগুনের লেলিহান শিখার মতো মুক্তিকামী মানুষের দাবানল রাজপথ থেকে মফস্বল, মফস্বল থেকে গ্রাম-গ্রামান্তরে, দেশজুড়ে ছড়িয়ে যায়। রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে।

১৯৬৮ সালের শেষদিকে আইয়্যুবের স্বৈরশাসনের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঘটা করে ‘উন্নয়ন দশক’ উদযাপনে মাতোয়ারা হয় ক্ষমতাসীন মহল। কে জানতো এই মাতোয়ারা আত্মতুষ্টির আড়ালেই তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে বিপরীত কিছু! ‘উন্নয়ন দশক’ এর ডামাডোলের মাঝেই পাকিস্তানের উভয় অংশ ধীরে ধীরে অশান্ত থেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে। ‘উন্নয়ন দশক’ উদযাপনের এক পর্যায়ে ৫ ডিসেম্বর আইয়্যুব খান ঢাকায় এলে ৬ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানীর আহবানে দেশব্যাপী পূর্বঘোষিত ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয়। ঐ দিনের জনসভায় ভাসানী বলেন, ‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এ দাবি মানা না হলে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কায়েম করা হবে।’ মুহুর্তেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে শ্লোগান উঠল ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা জিন্দাবাদ’। সভায় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সকল রাজবন্দীদের মুক্তি, সার্বজনীন ভোটাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান তিনি। একই সভায় তিনি আইয়্যুব খানকে অবসর নেয়ার পরামর্শ দেন। সভা শেষে তাঁর নেতৃত্বে একটি মিছিল গভর্নর হাউস ঘেরাও করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। শুরু হয় ‘ঘেরাও-আন্দোলন’-এর নতুন অধ্যায়। সেখানে পুলিশের সঙ্গে জনতার খন্ড যুদ্ধ হয়। বিক্ষোভকারীরা বায়তুল মোকাররমের সামনে সমবেত হলে তিনি এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে পরদিন ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানান। পাকিস্তান অবজারভার লিখল, ‘Bhasani’s calls for mass movement.’ পরদিন ঢাকায় এক অভূতপূর্ব হরতাল পালিত হয়। পুলিশের গুলিতে দু’জন নিহত হবার খবরে বিরোধী ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা জাতীয় পরিষদ থেকে ওয়াকআউট করেন। সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ৮ ডিসেম্বর এক যুক্ত বিবৃতিতে ঢাকায় হরতালের আহ্বান জানান।
৮ ডিসেম্বর ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালনকালে ১৪৪ ধারার মধ্যেই বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সকল বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে আগের দিনের নিহতদের উদ্দেশ্যে গায়েবানা জানাযায় ইমামতি করেন মওলানা ভাসানী। এরপর এক বিবৃতিতে তিনি বলেন ‘আমার ৬০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে আমি এমন বর্বর সরকার আর দেখি নাই। এ সরকার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পর্যন্ত হামলা করে। মুর্দার জানাজা পড়তে বাধা দেয়। যে কোন উপায়ে এ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে জনগণতন্ত্র কায়েম করতে হবে।’ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল সফর করে জনগণকে বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলের কৃষক, শ্রমজীবী মানুষদের আন্দোলনে ঝাঁপিড়ে পড়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। ২৮ ডিসেম্বর পাবনায় এক বিশাল জনসভায় তিনি পররাষ্ট্রনীতি, দেশরক্ষা ও মুদ্রা ছাড়া সকল বিষয় প্রদেশের হাতে ছেড়ে দেয়ার দাবি করেন এবং অবিলম্বে নৌ বাহিনীর সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তরের দাবি জানান। সভা শেষে তার নেতৃত্বে একটি মিছিল পাবনা জেলা প্রশাসকের বাংলো ঘেরাও করে। দেশব্যাপী ‘ঘেরাও-আন্দোলন’ নতুন মাত্রা পায়। মওলানা ভাসানী এসমময় শহুরে মধ্যবিত্তের আন্দোলনকে গ্রামের নিম্ন শ্রেণীর সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সংগ্রামে পরিণত করেন।
১৯৬৯ সালের ২ জানুয়ারি পাঁচবিবিতে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ন্যাপের কার্যনির্বাহী পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সভায় সংসদ নির্বাচন বর্জন এবং পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনসহ শ্রমজীবী মানুষের বাঁচার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এসময় ৮ থেকে ১৪ জানুয়াারি সারা প্রদেশে ‘গণহত্যা ও দমননীতি’ বিরোধী সপ্তাহ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাসানীর সঙ্গে পাঁচবিবিতে দেখা করে বৃহত্তর আন্দোলনের ব্যাপারে আলোচনা করেন। তার আগে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরীর সাথেও আওয়ামী লীগ-ন্যাপের ঐক্যের ব্যাপারে তাঁর আলোচনা হয়।
এদিকে ৪ জানুয়ারি ডাকসুসহ চারটি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ, ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ এবং এনএসএফ এর সমন্বয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। শুরু হয় আন্দোলন সংগ্রামের নয়া পটভূমি। ১০ জানুয়ারি বগুড়ায় প্রতিবাদ সপ্তাহ শেষ করে ১১ জানুয়ারি ঢাকা পৌঁছে মওলানা ভাসানী বলেন ‘আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি এবং সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের অবসানের কর্মসূচি’ গ্রহণ না করলে ন্যাপ ডাক-এ যোগদান করবে না। ১৪ জানুয়ারি ঢাকার হাতিরদিয়া জনসভায় ভাসানী বলেন, ‘সার্বজনীন ভোটাধিকার, লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন অর্জিত না হলে আমরা (পূর্ব পাকিস্তানীরা) খাজনা-ট্যাক্স ইত্যাদি বন্ধ করে দেব। তিনি আরও বলেন, কৃষকের হাতে বন্দুক নাই কিন্তু তাদের দমন করার ক্ষমতা সেনাবাহিনীরও নাই।’ এরপর তিনি গণআন্দোলনকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ১৪-১৫ জানুয়ারি সিলেট, ১৬ জানুয়ারি কুমিল্লা, ১৭ জানুয়ারি নোয়াখালীর রামগতি, ১৮-১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম এবং ২০ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জনসভায় ভাষণ দান করেন। এসময় তিনি সরকারবিরোধী আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য জনগণের প্রতি উদাত্ব আহ্বান জানান।
১৭, ১৮ এবং ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ এবং ছাত্র বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমস্ত নগরী। আন্দোলনের চতুর্থ দিন ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ)- এর ঢাকা হল শাখার সভাপতি ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। তাঁর মৃত্যু ঊনসত্তরের ছাত্র-গণআন্দোলনের গোটা অবয়বকেই পাল্টে দেয় এবং আইয়্যুব খানের শাসন ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ২০ জানুয়ারির হত্যা-জুলুমের প্রতিবাদে পরদিন, ২১ জানুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়। পল্টন ময়দানে লক্ষ ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এবার ছাত্র আন্দোলন ও ভাসানীর জ্বালাও-পোড়াও-ঘেরাও আন্দোলন এক হয়ে নতুন মাত্রা যুক্ত হয় গণঅভ্যুত্থানে।

৭ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করেন। এর আগেই তিনি ছাত্রদের ১১ দফায় সমর্থন জানিয়েছিলেন। ৯ ফেব্রুয়ারি খুলনা মিউনিসিপাল পার্কে এক বিরাট জনসভায় তিনি বলেন, ‘১১ দফা মেনে নিলে আমি গোলটেবিল বৈঠকে যেতে রাজি আছি।’ তিনি আরও বলেন ‘১১ দফা ও ন্যাপের ১৪ দফায় কোন পার্থক্য নেই। সুতরাং এগুলো মেনে নিলে তবেই সরকারের সঙ্গে বৈঠক, তার আগে নয়।’
১১ ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাটের এক জনসভায় মওলানা ভাসানী পুনরায় গণআন্দোলনের ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘ডাক’-এর আট দফায় আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা নেই, সুতরাং তা পরিত্যাজ্য। এদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হলে, পরদিন ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় ভাষণদান কালে মজলুম জননেতা বলেন, “প্রয়োজন হলে ফরাসি বিপ্লবের মত জেলখানা ভেঙ্গে মুজিবকে নিয়ে আসবো। দুই মাসের মধ্যে ১১-দফা কায়েম এবং রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া না হলে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হবে।” সভার প্রারম্ভে লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে সার্জেন্ট জহুরুল হকের গায়েবানা জানাযায় ইমামতি করেন মওলানা ভাসানী।

১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ শামসুজ্জোহা সেনাবাহিনীর হাতে শহীদ হন। প্রতিবাদে ১৮ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “দেশে গুলি চলছে, আছে সান্ধ্য আইন ও ১৪৪ ধারা জারি; এবং অন্যান্য চরম নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা; সেনানিবাসে নিরস্ত্র মানুষের ওপর চলছে গুলি; মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এখনও প্রত্যাহার করা হয়নি এবং শেখ মুজিবকেও মুক্তি দেওয়া হয়নি। এই অবস্থায় গোলটেবিল বৈঠক প্রহসন বৈ কিছু নয়। তিনি মুজিবসহ সকল রাজবন্দীকে মুহূর্ত বিলম্ব না করে মুক্তি দেয়ার দাবি করেন এবং সকল মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। ফলে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বিনাশর্তে শেখ মুজিবসহ অভিযুক্তদের মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি পেয়ে ঐ দিন রাতেই শেখ মুজিব ভাসানীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং দীর্ঘ সময় তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। এরকম অবস্থায় জনতার দাবির চাপে ১৯৬৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়।

১০ থেকে ১৩ মার্চ পিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান না করে তার জ্বালাও পোড়াও ঘেরাও আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। একপর্যাযয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে অপসারণ করা হয়। তাতেও পরিস্থিতির কোনো হেরফের না হলে ২৪ মার্চ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আইয়্যুব খান। ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়। আইয়্যুবের পতনে ভাসানীর অবিস্মরণীয় অবদানের প্রেক্ষিতে বিখ্যাত টাইম সাময়িকীতে ‘প্রফেট অফ ভায়োলেন্স’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বলা হয়ঃ
“আকন্ঠবিস্তৃত দাড়ি, এই মানুষটির উজ্জ্বল মুখমন্ডলে পারলৌকিক প্রশান্তির ছাপ। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা থেকে ৬০ মাইল দূরে একটি গ্রামে তিনি নাতি-নাতনিদের কাছে যেমনি স্নেহপরায়ণ খেলার সাথী, তেমনি দেশের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র বাঙালি কৃষকের কাছে এই ৮৬ বছর বয়স্ক আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রাণের ‘হুজুর’। কিন্তু এই দয়ালু স্নেহশীল দাদুই পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘হিংসাত্মক’ কার্যকলাপের একজন প্রধান উদগাতা।

একজন, শুধু একজন মানুষই, গত মাসে (মার্চ ১৯৬৯) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং ‘লৌহমানব’ নামে খ্যাত আইয়্যুব খানকে গদিচ্যুত করতে বাধ্য করেছেন। এই মুহুর্তে ভাসানীই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত গোলযোগপূর্ণ দেশে সামরিক আইন দিয়ে ভঙ্গুর শান্তি ফিরিয়ে আনলেও, তিনিই এখন সেই সামরিক আইনের একমাত্র একক আতঙ্কস্বরূপ। ভাসানীর প্রধান বাঙালি প্রতিদ্বন্ধী নরমপন্থী শেখ মুজিবুর রহমানসহ পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা একটি ভীতির কারণে নিশ্চুপ। কিন্তু ভাসানী অকুতোভয়। বাঁশের বেড়া দেয়া ক্ষুদ্র কুঁড়েঘরে তাঁর অনুসারী ও সাংবাদিকদের এখনো অবারিত দ্বার। ‘ভয়, আমার আবার ভয় পাবার কী আছে?’ বেতের টুপিটি মাথায় আঁটতে আঁটতে এবং সবুজ সোয়েটারটা শরীরে গলাতে গলাতে টাইম পত্রিকার সংবাদদাতা, ডান কোগিনকে মওলানা বলেন, ‘আমি আমার দেশবাসীর জন্য ফাঁসিতে ঝুলতেও প্রস্তুত।’

সকল রাজনৈতিক নেতা যেখানে ভয়ে চুপ করে আছেন, ভাসানী সেখানে নিরব তো ননই বরং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি নোটিশ জারি করেছেন- ভাসানীসহ দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে শিঘ্র দেশের সমস্যাসমূহ সমাধান করার জন্য আলোচনা শুরু না করলে তিনি আবার আন্দোলন শুরু করবেন।

মওলানা ভাসানী অধিকতর অর্থনৈতিক সুবিধাভোগী পশ্চিম পাকিস্তানের জুলুমের বিরোধী। তিনি অবিলম্বে দীর্ঘকালের পুরনো বৈষম্যের সমাধান দাবি করেন। ‘তা না হলে’, মওলানা বলেন, ‘জনগণ আইয়্যুবের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে যা করেছে, জেনারেল ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধেও তাই করতে বাধ্য হবে। কিন্তু এবারের আন্দোলন আরও ভয়াবহ হবে।’
‘পাকিস্তানিরা কি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সত্যি বিদ্রোহ করবে?’

ভাসানী ক্রোধভরে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘সাড়ে বার কোটি পাকিস্তানীদের কি সেনাবাহিনীর পক্ষে হত্যা করা সম্ভব? ভিয়েতনামের অধিবাসীরা কি প্রাণের ভয়ে যুদ্ধ থামিয়েছে? আমরাও তাদের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিবাসী। অসন্তোষের আগুন একবার জ্বালানো হলে জনগণ কিছুতেই থামবে না।’
ভাসানীর বাগ্মিতায় সত্যতা আছে। এতকাল পাকিস্তানের অধিবাসীরা সেনাবাহিনীর প্রতি বিরূপ হবার কোন ইচ্ছা প্রকাশ করেনি।

ভাসানীর অনুসারীরা প্রধানত পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকগণ। তিরিশ থেকে চল্লিশ লক্ষ আতঙ্কজনক পল্লীবাসী তাঁকে জিন্দাপীরের মতোই সন্মান করেন। গত ষাট বছর ধরে তিনি প্রথমে ব্রিটিশ শাসকের ও পরে জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। মওলানা ভাসানী নিতান্ত সাদাসিধাভাবে জীবনযাপন করেন, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ান এবং জনসাধারণকে ধর্ম ও রাজনীতি শিক্ষা দেন, যাকে তিনি ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করেন। ভাসানী কমিউনিস্ট নন, কিন্তু সম্পূর্ণ বামপন্থী রাজনীতিবিদ।

মওলানা ভাসানী একজন উদারপন্থী ধর্মতত্ত্ববিদও বটে, তিনি অদৃষ্টবাদ (মানুষের দুঃখ-কষ্ট অদৃষ্ট বা ভাগ্যের দোষে হয়ে থাকে- এই মতবাদ) স্বীকার করেন না। তিনি বলেন, আমাদের ধর্ম বিপ্লবী ধর্ম এবং আমি নিজে ধর্মানুসারী। সুতরাং ধার্মিক হিসেবে আমার কর্তব্য হচ্ছে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান- জেহাদ করা।

চীনের প্রতি তাঁর সমর্থন জানিয়ে মওলানা ভাসানী বলেন, ‘ধর্ম [সম্পর্কিত তাদের নীতি] ছাড়া সে দেশের সকল ব্যবস্থারই আমি প্রশংসা করি।’

এভাবেই ঊণসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, রাজনীতিবিদ সবার সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে সফলতা লাভ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পেক্ষাপট তৈরী করে দেয়। আর নিঃসন্দেহে মওলানা ভাসানী ছিলেন সেই আন্দোলনের পুরোভাগে।

আজাদ খান ভাসানী
সদস্য সচিব, ভাসানী পরিষদ ও প্রকল্প সমন্বয়ক, ভাসানী গবেষণা প্রকল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *