পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল (পড়ুন স্ক্যাম) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এখন এমন এক রঙিন নাটক মঞ্চস্থ করছে, যা দেখতে গিয়ে কৌতুকেরও কপালে ভাঁজ পড়ে। তাদের নতুন কৌশল? ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ এর নামে আমেরিকার কাছে গিয়ে কাঁদুনি গাওয়া। নাকি, নতুন সংখ্যালঘু নাটকের প্লট বানিয়ে নিজেদের নিষ্পেষিত দেখানো! ট্রাম্পকে জাতির পিতা বানিয়ে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার এত হাস্যকর প্রচেষ্টা দেখে দেশের মানুষ পর্যন্ত এবার আকাশে মুচকি হাসছে। মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এবার জোকারের ডিপার্টমেন্ট খুলে ফেলেছে, আর তারা চান যে ট্রাম্প বাবাও এসে তাদের এই খপ্পরে হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমাদের দেশের মানুষ তো এখন এমন মোডে আছে যে, তারা ঠিক করেছে, ট্রাম্প হোক আর বাইডেন—যেই নামুক না কেন, যদি আওয়ামী লীগের গন্ধ লাগে, তাহলে এক চড়েই উত্তর দিবে। “জয় শ্রী ট্রাম্প!” বলে আওয়ামী লীগের গায়ে ফুল লাগালেও, বাংলাদেশের জনগণ সেটা ছুঁড়ে ফেলার জন্য আরেকবারও ভাববে না। এই হাস্যকর খেলা দিয়ে কী বোঝাতে চায় তারা?
আওয়ামী লীগের নিজস্ব নাটকের মঞ্চে সবকিছুই সম্ভব, এমনকি নিজেদের সংখ্যালঘু হিসেবে প্রমাণ করার প্রচেষ্টা। এরা দেশের বিভিন্ন শ্রেণিকে সংকটে ফেলে এখন নিজেকে “নির্যাতিত” প্রমাণ করতে চায়। মজলুম সাজতে চাওয়া এদের ভন্ডামির নতুন স্টাইল—যেন নিজেরই পকেটে রাখা মার্কিন নাগরিকতার তকমা দেখিয়ে বলছে, “দেখো ভাই, আমরাও আরেকটা ক্ষুদ্র সম্প্রদায়!” আহা, কী দুঃখের দৃশ্য! অথচ তারা নিজেরাই যে দলিত মানুষের ঘাড়ে পা দিয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা তারা বেমালুম ভুলে গেছে।
একদিকে প্রহসন, অন্যদিকে অতীতের সকল প্রাসঙ্গিক রীতিনীতি ও সত্যকে উপেক্ষার এক চূড়ান্ত উদাহরণ। দেশের জনগণের অনুভূতি নিয়ে অবজ্ঞার খেলা যেন তাদের প্রাতিষ্ঠানিক মনোভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের সুবিধার্থে গণতন্ত্রকে পণ্য বানিয়ে, স্বৈরতান্ত্রিকতার ছদ্মবেশে এই যে অপকৌশল, তা চরম রাজনৈতিক নাট্যরূপ ছাড়া আর কিছু নয়। আওয়ামী লীগের বর্তমান কৌশল পর্যালোচনায়, তাদের অবস্থান একেকবার সংখ্যালঘু, একেকবার মজলুম, আবার একেকবার গণতন্ত্রের ত্রাণকর্তা। কিন্তু এসব কেবলই নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নাটক। আজ যখন তারা আমেরিকার ট্রাম্প-বাদিতায় নিজেদের মুক্তি খুঁজছে, তখন প্রশ্ন উঠে—সত্যিই কি তাদের লক্ষ্য গণতন্ত্র, নাকি এই নাটক এক নির্লজ্জ কৌশল মাত্র? এদের এই নতুন সংখ্যালঘুত্বের গল্প দেশের বাস্তব চিত্রকে প্রতিফলিত করে না, বরং সাধারণ মানুষের মুখে এক ধরনের বিষণ্ন হাসি এনে দেয়।
রাজনীতির প্রকৃত স্বরূপ এই যে, জনগণের প্রতি সত্যিকারের দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন শক্তি কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। একটি সময় পর্যন্ত সহ্য করা যায়, কিন্তু তারপর প্রতিরোধের ঢেউ গড়ে উঠে। আজ বাংলাদেশে তাই হয়েছে। আওয়ামী লীগ আজ এক জোকারে পরিণত হয়েছে, যার প্রতিটি পদক্ষেপ হাস্যরস ও ব্যঙ্গাত্মক বক্তব্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। যেন এক অভিজাত নাট্যমঞ্চে কৌতুক অভিনেতার ভূমিকায় নেমেছে তারা, আর দর্শকরা সেই নাটক দেখে যেমন হাসছে, তেমনি পরিণতি সম্পর্কে অজানা নয়।
সাহিত্যের ভাষায় বলতে গেলে, আওয়ামী লীগ আজ আত্ম-নির্মিত মিথ্যাচারের এক উপাখ্যান। রাজনীতির এই অবিনীততা ও গণতন্ত্রের বিপরীত যাত্রা বারবার নতুন ছাঁচে নতুন মঞ্চে ফিরে আসছে। তারা সংখ্যালঘুত্বের অজুহাতে নিজেদের দায়মুক্তি খুঁজছে; অথচ সেই সংখ্যালঘু মানসিকতাই তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রতীকী কাঠামো হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবি নজরুল যেমন দুঃশাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন, তেমনই বর্তমান প্রেক্ষাপট আমাদের সামনে নতুন এক সংগ্রামী ভাষা সৃষ্টি করতে উৎসাহ দেয়, যেখানে গণতন্ত্র হবে স্বাধীনতার পথ, কোনো চতুর ছদ্মবেশের আবরণ নয়।
আওয়ামী লীগ যদি সত্যিই গণতন্ত্রের পক্ষপাতী হতো, তাহলে এই ধরনের মিথ্যাচার ও ফ্যাসিবাদী মানসিকতা পরিত্যাগ করত। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার জন্য ভণ্ডামি ও ছদ্মবেশকে আঁকড়ে ধরেছে তারা। এদের এই ছলচাতুরী আর আত্ম-অহংকার একদিনে সৃষ্টি হয়নি, বরং বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতার লোভে একধরনের নিষ্ঠুর সত্য গড়ে তুলেছে।
এখন যে চিত্রটা চলছে, সেটা আরও মজাদার। আওয়ামী লীগ নিজেদের রক্ষার জন্য কতো নিচে নামতে পারে, তার এক চমৎকার উদাহরণ হলো এই ট্রাম্পের সামনে গিয়ে মাইর খাওয়া সংখ্যালঘু সাজা। দেশের সাধারণ মানুষ চরম বিরক্ত এই নাটকের পাগলামী দেখে। আর তারা নিজেরাও সব দিক দিয়ে ব্যর্থ হয়ে এই অতি-চরিত্রে মিশে যাওয়ার জন্য মরিয়া।
আরেকটা ব্যাপার অসাধারণ। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে শত মতভেদ থাকলেও, সবাই মিলে আওয়ামী লীগকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। অন্যসব বিষয় নিয়ে যতই ঝগড়া হোক, আওয়ামী লীগকে নিয়ে কথা উঠলে সবাই এক কাতারে এসে দাঁড়ায়। ছাত্ররা বিএনপির সাথে ঝগড়া করে, বিএনপি জামায়াতের সাথে দ্বন্দ্বে নামে, কিন্তু আওয়ামী লীগের বিষয়ে এদের মধ্যে বিরোধ নেই। তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে একটাই লক্ষ্য—ওদের বের করে দেওয়া।
আওয়ামী লীগের “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার” নাটকের ছলে যে তত্ত্ব-তালাশ চলছে, তার পিছনে অনেক পুরোনো রঙ্গমঞ্চের গল্প আছে। ইতিহাসে এমন অনেক তত্ত্ব আছে, যা পরিহাসের মতো, কিন্তু কিছু লোক তা গম্ভীর মুখে প্রচার করে গেছে। আজকের এই “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার” রঙ্গ যেন সেই পুরোনো “মেকিয়াভেলির রাজনীতি” এবং “ফ্রয়েডের অজানা আতঙ্ক তত্ত্বের” হাস্যকর মিশেল।
প্রথমেই দেখি “মেকিয়াভেলি তত্ত্ব”। ইতালির এই রাজার পরামর্শদাতা বলেছিলেন, ‘জিততে হলে সবকিছু জায়েজ।’ আওয়ামী লীগের মনেও মনে হয় সেই কথাই গেঁথে গেছে—যতই হোক, ক্ষমতায় থাকা মানে যা খুশি তা করো, কিন্তু সব ঠিক! আজ ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ নামক যে নাটকীয় প্রপঞ্চ তারা নিয়ে এসেছে, সেটা যেন এক মোক্ষম মেকিয়াভেলির রাজনীতির খেলা, যেখানে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা এমনভাবে পাল্টানো হয়েছে যেন সেটি তাদের নিজস্ব সম্পত্তি। জনগণ চায় না বলেই হয়তো তাদের ধারণা হয়েছে, ‘গণতন্ত্র মানে আওয়ামী লীগ’, আর বাকি সবই গৌণ।
এবার আসি “ফ্রয়েডীয় তত্ত্বে”। ফ্রয়েড বলেছিলেন, মানুষের মনে এমন এক ধরনের ‘দমন’ কাজ করে, যা তাকে অজান্তে ভয় আর ছলনায় নিমজ্জিত করে। আওয়ামী লীগকে দেখলে এখন সেই মনস্তত্ত্বের চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে—নিজেদের মিথ্যে দাবি দিয়ে যতই আত্মপ্রেমের বুলি আওড়াক, মনে এক অজানা ভয় ও দমন কাজ করছে। আজ তারা গণতন্ত্রের মুখোশ পরে আছে ঠিকই, কিন্তু এই ভয় তাদের এমনভাবে তাড়া করছে যে তারা কখনো জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না, আর আমেরিকার কাছে গিয়ে প্রমাণ করতে চায়—‘আমরা তো গণতন্ত্রেরই হর্তাকর্তা!’
একটু ঘুরে দেখি “বার্নার্ড শ’ তত্ত্ব”। তিনি বলেছিলেন, “রাজনীতি হলো এক ধরনের অভিনয়, কিন্তু পার্থক্য হলো, সিনেমার অভিনয়ে মেকআপ লাগে আর রাজনীতিতে লাগে চামড়া।” আওয়ামী লীগ নিজের চামড়ায় এমন মোটা মেকআপ দিয়েছে যে, তাদের এখন নিজেরাই নিজেদের চিনতে পারে না। জনগণের জন্য গণতন্ত্রের এই অভিনয় তারা করে যাচ্ছে, কিন্তু জনগণের মেকআপ খুলে দিয়েছে অনেক আগেই। জনগণের মুখে আজ সেই করুণ হাসি—যেমনটা আমরা “বেকুবের মেলা”তে দেখি।
এবার দেখি “হেগেলীয় তত্ত্ব”। হেগেল বলেছিলেন, “প্রত্যেক পরিস্থিতির সঙ্গে তার উল্টো কিছুর সংঘর্ষ তৈরি হয় এবং সেখানে নতুন কিছুর জন্ম হয়।” আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও সেই তত্ত্ব ঠিক প্রযোজ্য। তারা “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার” বলে যে প্রহসন করছে, জনগণের মধ্যে তাতে বিপরীত প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়েছে। এখন দেশের মানুষ তাদের সেই অভিনয়ের বিরুদ্ধে এক নতুন গণতন্ত্রের খোঁজে বের হয়েছে। তাদের এই ছদ্মবেশী নাটক দেখে মানুষ চায় এমন এক গণতন্ত্র, যা হবে মুক্ত, যা হবে স্বাধীন, যা কোনো একক দলের অধিকারভুক্ত নয়।
আরো একটি মজার তত্ত্ব হলো “রোমান সাম্রাজ্য তত্ত্ব”। রোমানরা যখন তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল, তখন তারা মানুষকে বিনোদন দিয়ে রেখে বলত, ‘আমাদের সাম্রাজ্যই আসল এবং চিরস্থায়ী।’ আওয়ামী লীগও যেন ঠিক তাই করছে। তাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার কেবলই লোক দেখানোর জন্য এক রোমান জুলুস। কিন্তু আজকের দিনে মানুষ আর সেই প্রাচীন রোমের নাগরিক নয় যে, মিথ্যের বিনোদন দেখেই সন্তুষ্ট থাকবে। মানুষ এখন জানে, স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র অর্জনের মানে, এবং আওয়ামী লীগের এই নাটক তাদের কাছে এক করুণ ব্যঙ্গ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
এখন দেখা যাক “গুজব তত্ত্ব”। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের যে পুনরুদ্ধার অভিযান করছে, সেটার মধ্যে গুজবের রসায়ন আছে। গুজব হলো এক ধরনের অপ্রমাণিত কথা, যা মানুষকে সাময়িকভাবে উত্তেজিত করে। আওয়ামী লীগ নিজেরাই আজ যেন গুজবের আবিষ্কারক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে নিজেরাই নিজেদের গণতন্ত্রের পক্ষে দাবি করে। এই গুজব রটিয়ে তারা হয়তো নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় আছে, কিন্তু জনগণ এতদিনে সেই গুজবের আসল চেহারা দেখে ফেলেছে।
এই সব তত্ত্বের মিশ্রণে যে হাস্যকর কাহিনী সৃষ্টি হয়েছে, তা এখন দেশের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ। আওয়ামী লীগ যতই নাটক করুক না কেন, জনগণের দৃষ্টিতে তাদের অবস্থান এক করুণ ব্যঙ্গ।
সত্যি কথা বলতে, এই “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার” আওয়াজটা এমনই এক বানোয়াট কৌতুক যে, সেটা শুনে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হওয়ার জোগাড়। ক্ষমতায় টিকে থাকার এই ছলচাতুরী জনগণের কাছে আজ চিরচেনা হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের মেধাহীন এই নাটকের শেষ পরিণতি হচ্ছে জনগণের চোখে আরও হাসির পাত্র হয়ে যাওয়া। তারা যে গণতন্ত্র মানে না, আর শুধু নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে এই সব মুখোশ পরে আছে—এটা সকলেই বুঝে গেছে।
ট্রাম্পকে দিয়ে নাচানোর এই অভিনয়েও এবার ব্যর্থ হওয়া ছাড়া তাদের আর গতি নেই। বাংলাদেশের মানুষ চুপচাপ বসে থাকেনি, তারা এই নাটকের শেষ দেখার জন্য প্রস্তুত। আর ট্রাম্পের আশীর্বাদ নিয়ে এরা যতই মুখ ঢাকার চেষ্টা করুক না কেন, বাংলাদেশের মানুষ জানে—চুনোপুঁটির দল কোনো এককালে বাঘের স্বপ্ন দেখেছিল, আর এখন নিজেরাই জোকারের আসনে বসে গেছে!
লেখক: সাজিদ সামী চৌধুরী