“মুক্তির মন্দির সোপান তলে,কত প্রাণ গেল বলিদান লেখা আছে অশ্রজলে”
চোখের কোণায় অশ্রুধারায় কিংবা হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে ভেসে উঠে একটি নাম। এ যেন শুধু একটি নাম নয়, এটি এক ইতিহাস—যে ইতিহাসের কথা মনে পড়লেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, হৃদয়ে এক গভীর ডাক শোনা যায়, শহিদী কাফেলায় সামিল হওয়ার ডাক। বলছিলাম বাঙালি জাতীয়তাবাদের নির্ভীক এক সৈনিক, মুজিব কন্যার নব্য ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বারবার গর্জে ওঠা এক কণ্ঠস্বর—বীর চট্টলার প্রথম শহীদ বৈষম্যবিরোধী, হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের দ্বিতীয় শহীদ, ছাত্রদলের প্রথম শহীদ আমার সহযোদ্ধা, আমার ভাই শহিদ ওয়াসিম আকরামের কথা।
বাস্তব জীবনে তার সাথে আমার শতাধিকবার দেখা হয়েছে। আমার কমিটির একজন নেতা ও এলাকার ছেলে হিসেবে তার সাথে সম্পর্ক ছিল অন্তরঙ্গ। দেশের সার্থে দলের যেকোনো প্রোগ্রামে সে ছিল সক্রিয় এক কর্মী। ফ্যাসিবাদের বন্দুকের নল কিংবা হামলা-মামলার ভয় কখনো তাকে আদর্শ থেকে বিচ্যুত করেনি। এ যেন ২৪ বছর বয়সের আলেকজান্ডার, চোখে-মুখে সারাক্ষণ এক বিজয়ের নেশা। ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল তার অন্তরে।
নির্বাচন পূর্ববর্তী হরতাল/অবরোধ প্রতিটি আন্দোলনে সর্বকনিষ্ঠ হয়েও প্রথম সারিতে থাকত সে। জুলাই আন্দোলনের শুরু থেকেই সাধারণ ছাত্র হিসেবে সক্রিয় ছিল সে। ১৫ তারিখে যখন কেন্দ্রীয়ভাবে আমাদের সংগঠন আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিল, আমি সন্ধ্যায় প্রেস ব্রিফিং করে বললাম, “কাল থেকে সাধারণ ছাত্রদের অধিকার আদায়ে রাজপথে থাকব।” সে রাতের বেলা স্ট্যাটাস ছিল “ধন্যবাদ প্রাণের সংগঠন।” আমি রাতে সবাইকে জানিয়ে দিলাম, “কাল কোথায় কীভাবে অবস্থান নেবো।”
১৬ জুলাই সকাল ১১ টায় আমাকে আমার এক নেতা জানালো তারা মুরাদপুরের দিকে যাচ্ছে। আমি বললাম, “আমি ২ টায় আসবো।” ২ টায় বাসা থেকে বের হয়ে দেখি চারপাশে পুলিশ আর গুন্ডা বাহিনীর চেকপোস্ট। ওয়াসা মোড় যেতেই ৩টা বাজে। ততক্ষণে খবর পেলাম, ওয়াসিমসহ আমার ৪ সহযোদ্ধা মুরাদপুরের শিক্ষা ভবনে আছে, চারপাশে পুলিশ ও ছাত্রলীগ তাদেরকে ঘিরে রেখেছে। আমি সবাইকে বললাম, আস্তে আস্তে প্রবর্তক মোড়ে চলে আসতে, এখান থেকে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলবো।
সিএনজিতে বসে ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে একটা স্ট্যাটাস নজরে পড়ে—”চলে আসুন ষোলশহর”। এ যেন হার না মানা এক যোদ্ধার শেষ ঘোষণা, সবাই যখন নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই ওয়াসিম ফ্যাসিবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ভয়ানক অস্ত্রের বিপরীতে দেশের অধিকার আদায়ের লড়াই।
বিকেল ৪টায়, আমি আরো কয়েকজন সাধারণ ছাত্র নিয়ে প্রবর্তক মোড়ে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। একপর্যায়ে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। ইতিমধ্যে মহানগরের যুগ্ম আহ্বায়ক সালাহউদ্দীন ভাইয়ের সাথে দেখা। উনি দেখামাত্র বললেন, “মেডিকেল চলো, ওয়াসিম আহত।” ভাবলাম, হয়তো মারাত্মক কিছু হয়নি। ইমার্জেন্সিতে ঢুকে ওয়াসিমকে খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়লো স্ট্রেচারে থাকা একটি নিথর দেহ—ওয়াসিম, আমাদের ওয়াসিমের নিথর দেহ। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমরা সবাই পাথর হয়ে গেলাম, আমাদের সামনে ওয়াসিমের গুলিবিদ্ধ লাশ। মাথায় একটাই কথা আসছিল—তার আগের দিনের স্ট্যাটাস, “ধন্যবাদ প্রাণের সংগঠন, এই পরিচয়েই আমি শহিদ হব।” তখনো বুঝিনি, দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হবে কিনা। তবে, একটাই কথা মনে আসছিল, আমার ভাইয়ের প্রাণ বৃথা যেতে পারে না। যদি আত্মদান বৃথা যায়, বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়ে যাবে। রংপুরের নুরুল দীন ডাক দিয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে “জাগো বাহে কোনঠে সবাই।” আমাদের ওয়াসিম ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ডাক দিয়ে বলেছে, “চলে আসুন ষোলশহর।”
অবশেষে দেশ স্বাধীন হয়েছে, হাসিনামুক্ত হয়েছে, কিন্তু আফসোস, সেই স্বাধীনতার স্বাদ ওয়াসিম ভোগ করতে পারেনি। দীর্ঘ ১৮ বছরের মুক্তির যুদ্ধে ঝরে গেছে ছাত্রদলের আরো একটি প্রাণ, তবে মুক্ত হলো দেশ। ছাত্রদলের ওয়াসিম শুধু ছাত্রদলের সম্পদ নয়, সে এখন ইতিহাসের অংশ। ফ্যাসিবাদ বিরোধী এই যুদ্ধে ওয়াসিমই সাহস জুগিয়েছিল আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। এই এক ওয়াসিমই অনুপ্রাণিত করেছিল ছাত্রদলের শহীদ হওয়া আরো ১৪০টি প্রাণকে।
সময় বদলাবে, নতুন ভোর আসবে, যুগ-জমানা পাল্টে যাবে। কিন্তু ওয়াসিমের নাম নুর হোসেন কিংবা সালাম, জব্বার, রফিকের মতো অম্লান থাকবে বাংলার প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে, কারণ,
“ওরে ভয় নেই, তার ভয় নেই,
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান,
ক্ষয় নেই তার ক্ষয় নেই।”