ঘণ্টাখানেক হয়ে গিয়েছে, সায়ন্তনী দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায় একটি শপিং কমপ্লেক্সের টি-বারের সামনে এসে হাজির হয়েছে। অথচ এখনও ওর সঙ্গীদের কারও দেখা নেই।
একবছর আগে, এই দিনটাতে এই টি-বারে বসে ওরা সবাই মিলে ঠিক করেছিল, “ঠিক এক বছর পরে, আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, এই দিনটায় বিকেল চারটের সময়, এই টি-বারে সবাই আবার দেখা করব।” এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল একটাই— পারস্পরিক বন্ধুতার আকর্ষণ এক বছর পরে কার কতটা অবশিষ্ট রইল, তা একবার পরখ করে নেওয়া।
আজ ঠিক এক বছর বাদে সেই টি-বারের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর, সায়ন্তনী ভাবে, আর কেউ আসবে না বোধ হয়! আসার হলে ওরা এতক্ষণে সবাই চলে আসত নিশ্চয়ই। ওরা মানে ইন্দ্রজিৎ, আবির, দীপ্তাংশু, ইমন আর পায়েল।
ইন্দ্র, আবির, দীপ্তাংশু আর ইমন— চারজন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ত। দীপ্তাংশুর সঙ্গে ইমনের সম্পর্কটা অবশ্য কলেজের সহপাঠী হিসাবেই আবদ্ধ ছিল না। ওদের পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই, ওরা সারা জীবন একসঙ্গে এক ছাদের তলায় কাটানোর স্বপ্ন দেখত! ফোর্থ-সেমেস্টারের পরীক্ষা শেষ হওয়ার দিন, ওরা ঘুরতে ঘুরতে ঢাকুরিয়া অঞ্চলে এসে হাজির হল। ইন্দ্র প্রস্তাব দিল মধুসূদন মঞ্চে সন্ধ্যার শো-এ নাটক দেখার। কিন্তু ইমন ছিল নাকউঁচু, জেদি প্রকৃতির মেয়ে। ওর মতে বাংলা নাটকগুলো সব বোকা-বোকা ন্যাকামি, আঁতলামো আর সেলফ-কন্ট্রাডিকশনে ভরা। হল থেকে বেরোলেই নাটকের আর কিছুই নাকি মনে থাকে না ওর! অতএব নাটক দেখার বাসনা বিন্দুমাত্র নেই।
দীপ্তাংশু কোনওমতে ইমনকে রাজি করানোর পর, নাটকের টিকিট কাটা হল। কিন্তু নাটক শুরু হতে তখনও ঢের দেরি। পাশের শপিং-কমপ্লেক্সের ভিতরে ঢুকে, হাঁটতে-হাঁটতে ওরা একটা টি-বারে এসে ঢুকল। টি-বারের ভিতরটা বিন্যস্ত হলেও, খুবই অপরিসর। বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন চিন্তাধর্মী মানুষ একটানা বাক-বিনিময় করে চলেছে। চা-পানের সঙ্গে চলা সিগারেটের ধোঁয়ায় একটা আলো-আঁধারি পরিবেশ। একটা বড় টেবিলের এক কোণে ওদেরই সমবয়সি দু’জন মেয়ে বসে, নিজেদের মধ্যে বেশ উঁচু গলায় গল্প করছিল। দীপ্তাংশুরা ওদের পাশের চারটে খালি চেয়ারে চাপাচাপি করে বসে পড়ল।
এই চাপাচাপিটা অপছন্দ হওয়ায়, প্রতিবাদ জানিয়ে মেয়ে দু’টি আসন ছেড়ে উঠে পড়তে চাইলে, ইন্দ্র পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে, “আরে বোসো-বোসো! আমরা তো আর এখানে সংসার করতে আসিনি। চা-খাওয়া হয়ে গেলেই যে যার জায়গায় ফিরে যাব। কথায় আছে না, যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন’জন।”
ইন্দ্রের কথায় সবাই সমস্বরে হেসে উঠল। এর পরে দীপ্তাংশুদের সঙ্গে পরিচিত হতে আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করল না কিছুক্ষণ আগের দুই-প্রতিবাদিনী— সায়ন্তনী ও পায়েল।
টি-বারের সেই দিনের পরিচয়পর্বের পরবর্তী বছর-দুয়েক ধরে ছ’বন্ধু মিলে সিনেমা দেখা, কলকাতা জুড়ে বিভিন্ন মলে, নন্দন চত্বরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আড্ডা মারার অবকাশে পারস্পরিক মন দেওয়া-নেওয়ার স্তর পর্যন্তও পৌঁছে গেল খুব শীঘ্রই।
থার্ড-ইয়ারের শেষে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ের সুবাদে ওরা সকলেই নিজ-নিজ জীবিকারও সন্ধান পেয়ে গেল। দীপ্তাংশু আর ইমনের কর্মক্ষেত্র নির্ধারিত হল বেঙ্গালুরুতে। আবিরকে যেতে হবে পুণে আর পায়েলের জন্য অপেক্ষা করছিল চেন্নাই। ইন্দ্র নয়ডার চাকরিতে যোগ না-দিয়ে, ওর ইউনিভার্সিটি থেকেই এম টেক কমপ্লিট করে নেবে বলে মনস্থ করল। আর ইন্দ্র-অন্ত প্রাণ যার, সেই সায়ন্তনী কিন্তু হায়দরাবাদের লোভনীয় চাকরিটা হাতছাড়া করতে চাইল না।
কলকাতা ছাড়ার আগে দীপ্তাংশু আর ইমন যেমন আইনগতভাবে নিজেদের সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে নিল, সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আবির ও পায়েল-ও। তবে সায়ন্তনীর ইচ্ছা থাকলেও, ইন্দ্র ওর বাবার অর্থে ওদের ভালবাসার সম্পর্কের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য, আইনি সিলমোহর লাগাতে রাজি হল না।
একঘণ্টার উপর অপেক্ষা করার পরেও কেউ যখন এল না, সায়ন্তনী রীতিমতো বিরক্ত হয়ে টি-বারের চত্বর ছেড়ে পায়ে-পায়ে বড়রাস্তার উপরে এসে দাঁড়াল। ঠিক তখনই পিছন থেকে দীপ্তাংশু আর আবির একসঙ্গে ওর নাম ধরে ডাক দিল, “কী রে সায়ন্তনী, কোথায় যাচ্ছিস? ওরা কোথায়?”
“ওরা কোথায় মানে? পায়েল আর ইমনের খবর তো আমার চেয়ে তোরা ভাল জানবি। আর তোদের বন্ধু ইন্দ্র তো তাপ-উত্তাপহীন মৌনীবাবা। আমি ফোন করলে কথা হয়, নইলে নয়।”
সায়ন্তনীর কথা শেষ হওয়ার আগেই সায়ন্তনীর ফোনে পায়েলের নাম ভেসে উঠল! দীপ্তাংশু খেয়াল করল, সায়ন্তনী ফোন ধরতেই সায়ন্তনী ও আবির দু’জনেরই ভ্রু-দ্বয়ের অন্তর্বতী ভাঁজ দূর হয়ে, মুখে একটা যেন খুশির ঝলক দেখা দিচ্ছে।
কান থেকে ফোন না-সরিয়েই, আবির ও দীপ্তাংশুর দিকে তাকিয়ে সায়ন্তনী বলে উঠল, “ওরা আমাদের একটা ট্যাক্সি ধরে এখনই গড়িয়াহাটে যেতে বলছে। ইন্দ্র ওখানে ওদের একটা নতুন টি-বারের সন্ধান দিয়েছে। ইন্দ্রর সঙ্গে পায়েল এবং ইমন দু’জনেই আছে। ওরা আমাদের জন্য গড়িয়াহাট মোড়ে অপেক্ষা করছে।”
“তা হলে এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভটা কী! লেটস টেক আ ক্যাব,” দীপ্তাংশু বেশ উৎসাহ সহকারেই কথাটা বলল।
আবির গম্ভীর মুখে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না-দিয়ে, চট করে একটা হলুদ ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে, আবিরের হাত ধরে “ওঠ ওঠ” বলে জোর করে ট্যাক্সির ভিতরে উঠিয়ে দিয়ে, দীপ্তাংশু আর সায়ন্তনী ট্যাক্সিতে বসল। আবির ও পায়েল যে ইতিমধ্যেই লিগাল সেপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সে খবরটা দীপ্তাংশুর কানে আগেই পৌঁছেছে।
গড়িয়াহাট মোড় থেকে কয়েক-পা হেঁটে, ওরা ইন্দ্র-নির্ধারিত বাড়িতে ঢোকামাত্রই, ওদের প্রত্যেকের সামনে এক কাপ করে চায়ের সঙ্গে, একটা করে সাদা কাগজ ও পেন বাড়িয়ে দিলেন সোহম সেন। সোহম সেন হলেন কলকাতার একজন খ্যাতনামা গ্রাফোলজিস্ট। মানুষের হাতের লেখা দেখে, তার চরিত্র নির্ণয় করতে যেমন তিনি পারদর্শী, তেমনই সেই হাতের লেখা সংশোধনের মাধ্যমে, সেই মানুষটির জীবনের সমস্যা দূরীকরণেও সিদ্ধহস্ত। সম্পর্কে তিনি ইন্দ্রর ছোটকাকা।
সকলের কাছ থেকে স্বাক্ষরসহ একপৃষ্ঠা করে ইংরেজি হাতের লেখা নিয়ে, সোহম সেন মুখ খুললেন, “ঢাকুরিয়ার যে টি-বারে পরিচয়ের সূত্রে তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে, তোমাদের সঙ্গে আজ অন্য এক টি-বারের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাটা সম্পূর্ণভাবে ইন্দ্ররই। তোমরা তো সবাই জানো, ইংরেজি ছোট হাতের টি-এর দুটো অংশ আছে। একটা হচ্ছে টি-এর লম্বা দণ্ডায়মান অংশ, যাকে আমরা বলি টি-এর স্টেম বা কাণ্ড। আর দ্বিতীয় অংশটি হচ্ছে একটা সমান্তরাল রেখা, যা দিয়ে আমরা টি-এর স্টেম বা কাণ্ডটাকে দ্বিখণ্ডিত করি। এই দ্বিতীয় রেখাটিকেই আমরা টি-বার বলি।”
তারপর দীপ্তাংশু ও ইমনের লেখা কাগজ দুটো ওদের দু’জনের সামনে রেখে সোহম সেন জানালেন, “দ্যাখো, ইমন ওর ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরগুলোর স্টেম বা কাণ্ডের গায়ে কোনও টি-বার না-দিয়ে, টি-এর কাণ্ডের মাথার উপরে অনেক উঁচুতে টি-বার দিয়েছে। যা দেখে বোঝা যাচ্ছে, ওর জীবনের চাওয়া-পাওয়া, উচ্চাশা বাড়তে-বাড়তে বাস্তবের গণ্ডির ধরাছোঁয়ার বাইরে গিয়ে যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে। সে তার জীবনসঙ্গীকে নিয়ে বাস্তবজীবনে প্রবেশ করবে কীভাবে! স্বাভাবিকভাবেই তার বন্ধুর মধ্যে ক্রোধের সঞ্চার হতে বাধ্য। তাই টি-এর বার টানতে গিয়ে, দীপ্তাংশু রাগে হাতটা এমনভাবে ছুড়ে মারছে যে, ওর টি-বারগুলো বাঁ দিক থেকে ডান দিকে ক্রমশ সরু হতে-হতে তরবারির ফলার আকার ধারণ করেছে। এরা সুযোগ পেলে, এদের সামনের মানুষটাকে কথার তরবারি দিয়ে ফালা-ফালা করে দিতে পারে।
“আর পায়েলের প্রতিটা টি-বার দ্যাখো। ওর ‘টি’-এর কাণ্ড বা দাঁড়ি থেকে টি-বারগুলো যেমন বাঁ দিকে বহুদূরে পড়ে রয়েছে, তেমনই আবিরের টি-বারগুলো কী অদ্ভুতভাবে ডান দিকে যেন বহুদূরে ছুটে চলে যাচ্ছে। এর অর্থ হল, পায়েলকে যেন ‘কাল’-এ পেয়েছে। অর্থাৎ আজকের কোনও কাজ আজই এই মুহূর্তে করতে ওর মন চায় না। সবই ও ‘কাল করব’ বলে ফেলে রাখতে চায়, এমনকী প্রেমের আদর-ভালবাসাটুকুও। আর আবির ভবিষ্যতের দিকে এত দ্রুত ছুটে চলেছে যে, বর্তমানে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কারও কথা মন দিয়ে শোনারই অবকাশ ওর নেই। সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেলেও, ওর কিছু যায়-আসে না। দুটো বিপরীত চরিত্রের মানুষ পারস্পরিক সম্পর্কে জড়িয়েছে, ফলে যা হওয়ার তাই হতে চলেছে।”
পায়েলের দু’চোখ জলে ভর্তি। সেদিকে না-তাকিয়ে একটু থেমে, সায়ন্তনীর মুখের দিকে তাকিয়ে সোহম সেন আবার বলতে শুরু করলেন, “সায়ন্তনী ভাবছে, ওর আবার কোন সমস্যার কথা এবার আমি বলতে শুরু করব, কে জানে! সায়ন্তনীর টি-বারগুলো না-বেশি উপরে, না বেশি নীচে। না বাঁ দিকে, না ডান দিকে। একেবারে মাঝখানে, ব্যালান্সড পজ়িশনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তা সত্ত্বেও ওর মনে শান্তি নেই। ও ভাবে ওর বন্ধু-চয়নটা সঠিক হল কি না! সায়ন্তনীকে এই সংশয়ে ফেলার পিছনে যেমন দায়ী ওর টি-বারের নীচে ছোট্ট হুকগুলো, তেমনই দায়ী ইন্দ্রর টি-বার। ইন্দ্রর লেখায় টি-বারের আলাদা কোনও অস্তিত্বই নেই। উপর থেকে টি-এর দাঁড়িটা নীচে টেনে এনে বাঁ দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। তারপর গোলাকারে ডান দিকে গেছে। এইভাবে যারা টি-বার দেয়, তারা গডফাদারের পরামর্শ ছাড়া কোনও কাজই করতে পারে না,” এই সুযোগে ইন্দ্র সম্বন্ধে নিজের অবস্থানটাও সকলের সামনে পরিষ্কার করে দিলেন সোহম সেন।
“এতকিছু বলে, সবার মনে তো ভয় ধরিয়ে দিচ্ছ তুমি,” সোহম সেনকে থামিয়ে দিয়ে এবার কথা বলল ইন্দ্র।
“না-না, ভয়ের কী আছে! তোমরা হয়তো জানো না যে, ইন্দ্রও একজন ভাল গ্রাফোলজিস্ট। কার টি-বার-টা কেমন টানা উচিত, তা ও-ই তোমাদের গাইড করে দেবে। সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে ইন্দ্রর শেখানো এই টি-বারের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেলেই দেখবে, সকলের সব সমস্যা কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে! তখন দেখতে পাবে, তোমাদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব, পারস্পরিক ভালবাসা সব সংশয়ের ঊর্ধ্বে উঠে, তোমাদের সম্পর্কগুলোকেও কত সুন্দর করে তুলেছে।”